
কৃষিবিদ মনিরুজ্জামান বাবুল : আজ ৯ অক্টোবর। বিশ্ব ডাক দিবস । এবারের প্রতিপাদ্য-পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে প্রশান্তির বার্তা।সভ্যতার বিকাশে যোগাযোগের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কথার আগে ছিল 'বার্তা'! কখনও ধোঁয়ার সংকেত, কখনও দূতের কণ্ঠে, আর পরে সেটার পরিবর্তিত রুপ নেয় চিঠিপত্রে।
'চিঠি আইএ-হে; আইহে চিটি আইএহে.." পঙ্কজ উদাসের ভুবন মোহিনী গান, এটা শুধু গান নয়, তা জীবনের পরতে পরতে ছান্দিক সূর !
ইতিহাসের রাজদরবার, সাম্রাজ্যের পররাষ্ট্রনীতি কিংবা সাধারণ মানুষের প্রেম— সব ক্ষেত্রেই চিঠি ছিল জীবনের অনিবার্য অঙ্গ।
প্রাচীন যুগে রাজারা প্রজাদের খোঁজ রাখতে দূত পাঠাতেন। মোগল আমলে “ডাকচৌকি” ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রথম সংগঠিত ডাকযোগাযোগের সূচনা ঘটে। ব্রিটিশ শাসনামলে ডাকটিকিট চালু ও ডাকঘর স্থাপনের মধ্য দিয়ে আধুনিক ডাকব্যবস্থার বিকাশ ঘটে। সেই থেকে ডাক শুধু প্রশাসনিক আদানপ্রদানের মাধ্যম নয়, হয়ে ওঠে জনগণের আর্থসামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
১৮৫৪ সালে ইংরেজ শাসন আমলে ও ১৮৫৮ সালে বাংলায় পূর্নাঙ্গ ডাক টিকিট চালু হয়।স্বাধীন বাংলাদেশেও ডাক বিভাগ যোগাযোগ, মানি অর্ডার, সঞ্চয় ব্যাংক ও ই-কমার্স ডেলিভারিতে আজ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
তবে ডাকব্যবস্থা কেবল কাঠামোগত সেবা নয়— এটি মানবিক আবেগ ও অনুভূতির এক চিরন্তন বাহক। সেই আবেগের প্রতীক হয়ে আছে রাজশাহীস্ত ছদ্মনামে 'কমরেড' ও 'হৃদয় মল্লিকা'–র প্রণয় উপখ্যানে।
ম'ল্লিকা' প্রতিদিন ছোট ছোট চিরকুটে লিখতো রসাত্মক কথোপকথন! কখন যে ক্লাসরুমের দেয়াল পেরিয়ে সেই চিঠিগুলো হয়ে উঠেছিল জীবনের নির্মোহ বার্তা, তা বুঝে উঠতে পারেনি কমরেড নামের সেই তরুণ। জন্মদিনে মল্লিকার পাঠানো ১৫–২০ ফুট লম্বা পাতায় পাতায় জোড়া লাগানো সে চিঠি যেন ভালোবাসার এক অনবদ্য ইতিহাস— একটার পর একটা পাতা গাম লাগিয়ে গড়া সেই দীর্ঘ বার্তা ছিল তাদের সম্পর্কের প্রতীক, এক প্রশান্তির ডাক।
চিঠির প্রতিটি শব্দে ছিল জীবনের রঙিন উপাখ্যান— প্রজাপতির পাখার মতো বর্ণিল, ফানুসের আলোয় ভেসে থাকা আশা। মরু ক্লান্ত পথিকের মতো অপেক্ষার প্রহরে প্রতিটি চিঠি হয়ে উঠত নতুন প্রেরণা। ডাকবাক্সে জমে থাকা সেই চিঠিগুলো আজও সাক্ষী হয়ে আছে আবেগের নিঃশব্দ ইতিহাসের।
চিঠি শুধু শব্দ নয়— এটি অনুভূতির উত্তরাধিকার। রাজদরবারের কূটনৈতিক বার্তা, রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কিংবা সাধারণ মানুষের প্রেমপত্র— সবই ইতিহাসে স্থান পেয়েছে এই ডাক ব্যবস্থার কল্যাণে। আজ ডিজিটাল যুগে ই-মেইল, ইনবক্স ও ভিডিও কলের দ্রুততায় হারিয়ে যাচ্ছে হাতে লেখা চিঠির উষ্ণতা, কিন্তু হারিয়ে যায়নি তার হৃদয়ের ভাষা।
১৯৭৬ সালের 'অনুরোধ' ছায়া ছবির সে গান "চিঠি দিও প্রতিদিন, চিঠি দিও নয়লে থাকতে পারবোনা ! তদরুপ প্রবাসীর জন্য অল্পলেখাপড়া বউকে নিয়ে অনুভূতির গান "চিঠি লিখেছে. লিখেছে.. বউ আমার ভাঙা ভাঙা হাতে.."
হৃদয়ের রেখাপাতে প্রনয় মিলন পেরিয়ে অনুযোগ বিরহতেও আছে চিঠি র প্রগাঢ় মহত্ব!
শিল্পী শুভ্রদেব “এ আমার শেষ চিঠি, হয়তো তুমি পড়বে না…”
এই গানের মতোই আজকের প্রজন্ম হয়তো হাতেলেখা চিঠি পড়বে না, তবু এর অনুভব, চিঠির মমতা, আকুলতা ও প্রতীক্ষা প্রজন্মের কাছে ফিরলে তা হবে প্রশান্তিময় বার্তার এক নির্মোহঅবগাহন !
প্রযুক্তি বদলায়, কিন্তু সম্পর্কের ভাষা চিরায়ত আধুনিক, যা কমিউনিটি থেকে কমিউনিটিতে, কখনো কখনো হৃদয় ও সময়ের সীমানা ছাড়ায়ে তা চিরশ্বাস্বত রুপে ফিরে আসে।
লেখক-গবেষক ও এক্টিভিষ্ট-কমিউনিটি কেয়ার ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, পরিচালক, মমতা নার্সিং ইনস্টিটিউট